মঙ্গলবার, ৬ জানুয়ারী, ২০১৫

ওযুর সুন্নতী পদ্ধতি-

 রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন “যে ব্যক্তি পূর্ণভাবে ওযু করবে এবং কালিমা শাহাদাত পাঠ করবে, তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজাই খুলে দেয়া হবে। সে যেটা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে”। মুসলিম ১/২০৯, মিশকাতঃ ২৮৯।

 মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেন – ‘যে ব্যক্তি উত্তমরূপে ওযু করবে তার শরীরের গুনাহগুলি ধুয়ে যাবে, এমনকি তার আঙ্গুলের নখের নীচ থেকেও।’ (মুসলিম)

 

ওযুর সুন্নতী পদ্ধতি-

 

 

ওযুর নিয়ত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। ওযু হল পবিত্রতা আনয়নকারী কারন এটি আমাদের ছোট গুনাহ গুলোকে ধুয়ে ফেলে।

অযুর পদ্ধতিঃ



১) অন্তরে (মনে মনে) অযুর নিয়ত করবে।

অত:পর বিসমিল্লাহ বলবে, কেননা বিসমিল্লাহ না বললে অযু হবে না। 

এ সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন: “যে ব্যক্তি বিসমিল্লাহ বলবে না তার অযু হবে না। (আবু দাউদ ও আহমাদ)।


২) ডান হাতে পানি নিয়ে দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত তিনবার ধৌত করতে হবে। এসময় হাতের আংগুলগুলো খিলাল করতে হবে।

আবু দাউদ, মিশকাতঃ ৪০১, নাসায়ী মিশকাতঃ ৪০৫।
এসময় হাতে আংটি থাকলে রাসুলুলাহ (সাঃ) সেটা নাড়িয়ে ধৌত করতেন। ফিকহুস সুন্নাহঃ ১/৬১।



৩) তিন বার কুলি করবে এবং নাকে পানি টেনে নিয়ে নাক ঝাড়বে।এসময় ভালো করে কুলি করে মুখের সব অংশে এবং নাকের উপরের অংশ পর্যন্ত পানি পৌঁছাতে হবে।

অধিকাংশ মানুষ আগে কুলি করে পরে নাকে পানি দেয় – এটা ঠিকনা। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ডান হাতে পানি নিয়ে অর্ধেক পানি দিয়ে কুলি করতেন বাকি অর্ধেক পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করতেন, অর্থাৎ কুলি করা ও নাক ধোয়া একই সাথে করতেন।

আবু দাউদঃ ২৩৬৬, তিরমিযীঃ ৭৮৮।

৪) মুখমন্ডলকে এক কান হতে অন্য কান পর্যন্ত এবং মাথার চুল গজানোর স্থান থেকে শুরু করে দাড়ীর নিচের থুতনী পর্যন্ত তিনবার ধৌত করবে।


পুরুষদের মধ্যে যাদের দাড়ি ঘন তাদের ভেজা হাতে দাড়ি খিলাল করলেই হবে। আর যাদের দাড়ি হালকা বা মুখের সাদা চামড়া দেখা গেলে পানি পৌছানো ওয়াজিব। আর নারী বা যদের দাড়ি নেই তারা এক অঞ্জলি পানি থুতনীর নিচে দিবে, সেটাও মুখের অন্তর্ভুক্ত, তবে গলা ধৌত করবে না।


৫) হস্তদ্বয়কে আঙ্গুল থেকে কনুই পর্যন্ত তিনবার ধৌত করবে। প্রথমে ডান হাত পরে বাম হাত।

৬) নতুন করে পানি দিয়ে হাত ভিজিয়ে ভিজা হাত দিয়ে একবার মাথা মাসেহ করবে। দুই  হাতের ভেজা আংগুল একত্র করে মাথার অগ্রভাগ থেকে আরম্ভ করে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে আবার অগ্রভাগে নিয়ে এসে শেষ করবে।

তিনি (সাঃ) দুই হাতের ভেজা আংগুল দিয়ে মাথার সামনে হতে পেছনে ও পুনরায় পেছন থেকে সামনে বুলিয়ে পুরো মাথা একবার মাসাহ করতেন। একই সাথে ভেজা শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে কানের ভেতর অংশ এবং বুড়ো আংগুল দিয়ে কানের বাইরের অংশ মাসাহ করতেন। মাথায় পাগড়ি /স্কার্ফ থাকলে পাগড়ির উপরে ভেজা হাত দিয়ে সমস্ত মাথা মাসাহ করে নিতে হবে।

৭) উভয় কানে এক বার মাসেহ করবে। উভয়ের হাতের তর্জনী আঙ্গুলকে উভয় কানের ভিতরের অংশে প্রবেশ করিয়ে ভিতরের দিক এবং বৃদ্ধা আঙ্গুল দ্বারা উভয়ে কানের বাহিরের অংশ মাসেহ করবে। ঘাড় মাসে করবে না। কারণ ঘাড় মাসে করার ব্যাপারে যে হাদীস বর্ণিত আছে তা ঠিক নয়। এ জন্য ঘাড় সাসেহ করা বিদআত।

৮) প্রথমে ডান পা ও পরে বাম পা টাখনুসহ ভালোভাবে ধৌত করতে হবে। বাম হাতের আংগুলগুলো দিয়ে পায়ের আঙ্গুলগুলো খিলাল করতে হবে। এসময় খেয়াল রাখতে হবে, পুরো পা যেনো ভালোভাবে ধৌত করা হয়, অনেকের পায়ের গিটের নিচে পুরো অংশ পানি দিয়ে ধৌত করা    হয়না ।    এরকম করলে জাহান্নামে যেতে হবে, কারণ এই কারণে ওযু হয়না।

শীতকালে বা সফরে ওযু থাকা অবস্থায় মোজা পড়লে মোজা খুলে পা ধৌত করতে হবেনা, মোজার উপরে একবার মাসাহ করলেই হবে। আর চামড়া বা কাপড় যেকোনো মোজাতেই মাসাহ করা যাবে (তিরমিযী)।

মাসাহ করার নিয়মঃ দুই হাতে ভেজা আঙ্গুল পায়ের পাতা হতে টাখনু পর্যন্ত টেনে এনে একবার মাসাহ করতে হবে।

মুসলিম, মিশকাত ৫১৮।
ডান হাত দিয়ে ডান পা ও বাম হাত দিয়ে বাম পা মাসাহ করতে হবে।
ওযুর পরে সুন্নত হচ্ছেঃ
১. রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ওযু শেষে একটু পানি নিয়ে লজ্জাস্থান বরাবর ও আশেপাশের কাপড়ে পানি ছিটিয়ে দিতেন।
আবু দাউদ, নাসায়ী, মিশকাত ৩৬১, সহীহঃ আলবানী।
কারণ, শয়তান মানুষকে ওয়াসওয়াসা দেয় যে, তোমার পেশাবের ফোঁটা বের হয়েছে। এই কাজ করলে এই ওয়াসওয়াসা দূর হবে।
২. ওযু শেষ করে কালিমা শাহাদাত একবার পড়তে হবে,
 

 আশহাদু আল্‌-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্‌দাহু লা শারিকা-লাহু ওয়াআশ্‌হাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।



অর্থঃ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কোন মাবূদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল।

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন “যে ব্যক্তি পূর্ণভাবে ওযু করবে এবং কালিমা শাহাদাত পাঠ করবে, তার জন্য জান্নাতের আটটি দরজাই খুলে দেয়া হবে। সে যেটা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করতে পারবে”। মুসলিম ১/২০৯, মিশকাতঃ ২৮৯।
ওযু সম্পর্কে মাসয়া'লাঃ
১) আয়নাতে নিজের চেহারা দেখলে ওযু ভাংবেনা।
২) হাটুর উপরে কাপড় উঠে গেলে বা কাপড় চেঞ্জ করলে ওযু ভাংবেনা।
৩) বাচ্চাকে দুধ খাওয়ালে ওযু ভাংবেনা।
৪) নারীরা মাথায় কাপড় না দিয়েও ওযু করতে পারবে, তবে পরপুরুষের সামনে হলে ঢেকে রাখতে হবে।
৫) টিভি দেখলে বা নারীরা পরপুরুষকে বা পরুপুরুষ নারীকে দেখলে ওযু ভাংবেনা। তবে হারাম কোনো কিছু দেখলে বা দৃষ্টিপাত হয়ে থাকলে অবশ্যই গুনাহ হবে, কিন্তু এতে ওযু ভাংবেনা। 


ওযুর মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ঃ


### ওযুর জায়গা নখ পরিমান শুকনো থাকলে ওযু হবেনা। সহীহ তিরমিযী ৪১।
এইজন্য আস্তে ধীরে মনোযোগের সহিত সুন্দর করে ওযু করতে হবে। তাড়াহুড়া করে অন্য চিন্তা মাথায় নিয়ে ওযু করা অনুচিত, কারণ এতে যদি ওযু না হয় তাহলে নামাযই কবুল হবেনা! তাই আমাদের উচিত ওযু করার সময় খেয়াল রাখা।
১. ওযুর অংগগুলো একবার, দুই বার বা তিনবার ধৌত করতে হবে। একবার করা ফরয, সর্বোচ্চ তিনবার করা উত্তম। তবে মাথা মাসাহ বা পায়ে মোজা থাকলে পা মাসাহ একবারই করতে হবে। বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত ৩৯৫- ৩৯৭।
২. পানি অপচয় করা যাবেনা। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ওযু করতেন এক মুদ বা ৬২৫ গ্রাম পানি দিয়ে (প্রায় পৌনে এক লিটার)।
বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত ৪৩৯।
৩. ওযু শেষে ভেজা অংগ গুলো তোয়ালে দিয়ে মুছে ফেলা জায়েজ রয়েছে। ইবনে মাজাহ ৪৬৫, ৪৬৮।
৪. এক ওযু দিয়ে পরের ওয়াক্তের নামায পড়া জায়েজ – তবে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সবসময় নতুন করে ওযু করে নিতেন। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি একবার এক ওযু দিয়ে দুই ওয়াক্তের নামায পড়েছিলেন।
৫. কাপড়ের মোজার উপরে মাসাহ করা জায়েজ। তিরমিযীতে এর পক্ষে সহীহ হাদীস রয়েছে।
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামগণ (রাঃ) খুফ (চামড়ার মোজা) ও জাওরাবের (সুতী বা পশমী মোটা মোজার) উপরে মাসাহ করতেন।
বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, মিশকাত ৫৩-৫৪।
মুকীম বা গৃহে অবস্থান করলে একদিন একরাত (২৪ঘন্টা) সফরে তিনিদিন ও তিনরাতে পর্যন্ত একবার মোজা পড়ে মাসাহ করে যাবে, এর পরে ওযু করলে মোজা খুলে ধৌত করতে হবে।
## এমন জুতা যা টাখনু ঢাকে সেটা যদি পাক থাকে আর ওযু করা অবস্থায় পড়া হয়, তাহলে তার উপরেও মাসাহ করা জায়েজ।
আহমাদ, তিরমিযী, মিশকাত ৫২৩।
জুতার নিচে নাপাকী থাকলে তা মাটিতে ভালোভাবে ঘষে নিলে পাক হয়ে যাবে এবং ঐ জুতার উপরে মাসাহ করা চলবে।
আবু দাউদ, মিশকাত ৫০৩।
৬. শরীরে কোনো জখম বা ব্যান্ডেজ থাকলে ঐ অংশটুকুর উপরে ভেজা হাতে একবার মাসাহ করলেই হবে, ধৌত করতে হবেনা।
সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ ১/১৬১।
৭. ওযুর শুরুতে প্রয়োজনীয় কথা বলতে ও সালাম দিতে বা নিতে হাদীসে কোনো নিষেধ নেই।
৮. প্রত্যেক অংগ ধোঁয়ার সময় আলাদা আলাদ দুয়া – এইগুলো বেদাত। এইগুলো না রাসুলুল্লাহ (সাঃ) পড়েছেন, না সাহাবার করেছেন না চার ইমাম থেকে কোনো বক্তব্য আছে। যাদুল মায়াদ ১/৮৮।
৯. শরীরের যেকোনো স্থান থেকে কম হোক আর বেশি হোক রক্ত বের হলে ওযু নষ্ট হবেনা।
বুখারী, ২৯ পৃষ্ঠা।
১০. কাপড় চেঞ্জ করলে বা হাটুর উপরে কাপড় উঠে গেলে ওযু ভেঙ্গে যায়না।
১১. বমি হলে, নামাযের ভেতরে বা বাইরে উচ্চস্বরে হাসলে, মৃত ব্যক্তিকে গোসল দিলে বা বহন করলে ওযু ভেঙ্গে যায়না।

 

ওযু নষ্টের কারণগুলো কি কি?



প্রথমতঃ পেশাব-পায়খানাররাস্তা দিয়ে কোন কিছু নির্গত হওয়া।

দ্বিতীয়তঃ নিদ্রাযদি এমন অধিক পরিমাণে হয়, যাতে ওযু ভঙ্গ হয়েছে কিনা অনুভুতি না থাকে, তবে তা ওযু ভঙ্গেরকারণ।

তৃতীয়তঃ উটেরগোশত ভক্ষণ করা। উটের গোসত রান্না করে হোক, কাঁচা হোক খেলেই ওযু ভঙ্গ হয়ে যাবে।

 

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন