মঙ্গলবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১৫

নিফাক


ইসলামি শরিয়তে নিফাকের অর্থ: নিজেকে ভালো বলে প্রকাশ করা আর অন্তরে খারাবী ও অন্যায়কে গোপন করা।শরীয়তের পরিভাষায় নিফাকীর অর্থ হল ভেতরে কুফুরী ও খারাবী লুকিয়ে রেখে বাহিরে ইসলাম জাহির করা। একে নিফাক নামকরণের কারণ হলো সে এক দরজা দিয়ে শরীয়তে প্রবেশ করে অন্য দরজা দিয়ে বের হয়ে যায়। এ জন্যই এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন:

নিশ্চয়ই মুনাফিকরাই ফাসিক পাপচারী। [সূরা তওবা,৬৭]

এখানে ফাসিক মানে হল শরীয়তের সীমানা থেকে যারা বের হয়ে যায়। আল্লাহ মুনাফিকদেরকে কাফিরদের চেয়েও নিকৃষ্ট বলে গণ্য করেছেন।


নিঃসন্দেহে মুনাফিকরা থাকবে দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে। [সূরা নিসা,১৪৫]

‘তারা আল্লাহ এবং ঈমানদারগণকে প্রতারিত করতে চায়। অথচ তারা যে নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে প্রতারিত করেনা, তা তারা বুঝতে পারেনা। তাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে।আর আল্লাহ তাদের ব্যাধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। বস্তুতঃ তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি

কারণ তারা মিথ্যাচার করে বেড়াত। [সূরা বাকারা,৯-১০]

নিফাকীর প্রকারভেদ:

নিফাকী দুই প্রকার:

এক. বড় নিফাক- বড় নিফাক বা নিফাকে আকবর হল, মুখে ঈমান ও ইসলামকে প্রকাশ করা আর অন্তরে কুফরকে গোপন রাখা। রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এর যুগে এ প্রকারের নিফাকই ছিল। কুরআনে করীম এ প্রকারের মুনাফিকদের কাফের বলে আখ্যায়িত করে এবং তাদের নিন্দা করেন। আল্লাহ তা‘আলা জানিয়ে দেন যে, এ ধরনের মুনাফেক জাহান্নামের একেবারেই নীচের স্তরে অবস্থান করবে এবং তারা চির জাহান্নামী হবে। তারা কখনোই জাহান্নাম থেকে বের হতে পারবে না।

আল্লামা ইবনে রজব রহ. বলেন, নিফাকে আকবর হল, একজন মানুষ আল্লাহ, তার ফেরেশতা ও রাসূলগণ, আখিরাত দিবস এবং আসমানি কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান প্রকাশ করা আর অন্তরে উল্লিখিত বিষয় সমূহের প্রতিটির প্রতি ঈমানের পরিপন্থী অথবা যে একটির প্রতি ঈমানের পরিপন্থী বিষয়কে গোপন করা।

ফিকহবিদগণ মুনাফিকদের ক্ষেত্রে যিন্দীক শব্দটিও ব্যবহার করে থাকেন। তারা মুনাফিকদের যিন্দীক বলে আখ্যায়িত করেন।

আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম রহ. বলেন, “যিন্দীকের দল, তারা হল, যারা ইসলাম ও রাসূলদের আনুগত্য প্রকাশ করে এবং কুফর, শিরক, আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি বিদ্বেষকে গোপন করে। তারা অবশ্যই মুনাফেক এবং তারা জাহান্নামের সর্ব নিম্নে অবস্থান করবে। আর তাতেই তারা চিরকাল অবস্থান করবে”।

দুই. নিফাকে আমলী বা ছোট নিফাক:

নিফাকে আমলী বা ছোট নিফাকে লিপ্ত হল তারা, যাদের অন্তরে আল্লাহর উপর বিশ্বাস আছে এবং তাদের আক্বীদা সঠিক, তবে গোপনে দীনি আমলসমূহের উপর আমল করাকে ছেড়ে দেয়, আর প্রকাশ করে যে, সে আমল করে যাচ্ছে। এ ধরনের নিফাককে নিফাকে আমলী বা ছোট নিফাক বলে।

আল্লামা ইবনে রজব রহ. বলেন, “নিফাকে আসগর বা ছোট নিফাক হল, আমলের নিফাক। অর্থাৎ, কোন মানুষ নিজেকে নেক-কার বলে প্রকাশ করা আর অন্তরে এর পরিপন্থী বিষয়কে গোপন করা”।

একজন মুসলিমের অন্তরে সে ঈমানদার হওয়া সত্ত্বেও নিফাকে আসগর বা ছোট নিফাক একত্র হতে পারে। তাতে তার ঈমান নষ্ট হবে না। যদিও এটি কবিরা গুনাহসমূহের অন্যতম কবিরা গুনাহ। কিন্তু নিফাকে আকবর বা বড় নিফাক ঈমানের সাথে একত্র হতে পারে না। কারণ, এটি ঈমানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাই কোন বান্দা যখন আল্লাহর উপর ঈমান আনে, তার মধ্যে নিফাকে আকবর থাকতে পারে না।

কিন্তু যখন কোন মানুষের অন্তরে নিফাকে আসগর প্রগাঢ় ও মজবুত হয়ে গেঁথে বসে, তখন তা কখনো বান্দাকে বড় নিফাকের দিকে নিয়ে যায় এবং তাকে দ্বীন থেকে পরিপূর্ণ রূপে বের দেয়। ফলে সে ঈমান হারা হয়ে মারা যাওয়ার আশংকা থাকে। এ জন্য নিফাকে আমলীকে কখনোই খাট করে দেখার অবকাশ নাই।


দ্বীনের মধ্যে নিফাকের ধরন:

দ্বীনের বিষয়ে মুনাফেকি দুই ধরনের হতে পারে এক- মৌলিক, দুই- আকস্মিক সংঘটিত।

মৌলিক নিফাক দ্বারা উদ্দেশ্য হল, যে নিফাকের পূর্বে সত্যিকার ইসলাম ছিল না বা ইসলাম অতিবাহিত হয়নি। অনেক মানুষ আছে যারা দুনিয়ার ফায়দা লাভ ও পার্থিব স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে নিজেকে মুসলিম বলে আখ্যায়িত করে, মূলত: সে তার জীবনের শুরুতেই অন্তর থেকে ইসলামকে গ্রহণ করেনি ও আল্লাহর উপর ঈমান আনয়ন করেনি, সুতরাং এ লোকটি তার জীবনের শুরু থেকেই একজন খাঁটি মুনাফিক, যদিও সে মুখে ইসলাম প্রকাশ করে বা মুসলিম সমাজে বসবাস করে। আবার অনেক লোক এমন আছে যারা সত্যিকার অর্থে মুসলিম, ঈমানে তারা সত্যবাদী। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের বিপদ-আপদ ও মুসিবত যদ্বারা আল্লাহ তা‘আলা তাদের ঈমানের পরীক্ষা নিয়ে থাকে, তাতে তারা সফলকাম হতে পারেনি এবং ঈমানের উপর অটল থাকতে পারেনি। ফলে তাদের অন্তরে ইসলামের সন্দেহ- সংশয় সৃষ্টি হয় এবং তারা ইসলাম হতে মুরতাদ হয়ে যায়। তাদের উপর মুরতাদের বিধান প্রয়োগ করা হবে। আবার অনেক মানুষ আছে তারা দুনিয়ার কোন সুবিধা যা মুসলিম থাকলে লাভ করত, তা হতে বঞ্চিত হবে, এ আশংকায় সে তার মুরতাদ হওয়াকে গোপন রাখে। আর মুসলিম সমাজেই মুসলমানের নামে বসবাস করে। সে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয় না যে আমি মুরতাদ। বরং যখন কোন সুযোগ পায়, তখন ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিষোদাগার করে এবং বিদ্বেষ ছড়ায়। এ ধরনের মুনাফেক আমাদের সমাজে অনেক রয়েছে। তারা ইঁদুরের মত মুসলমানদের সমাজে আত্ম গোপন করে আছে। যখনই সুযোগ পায় ইসলাম ও মুসলিমদের ক্ষতি করতে কার্পণ্য করে না। আর সব সময় তারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।

একজন মুসলিম যখন কোন মুসলিম সমাজে বসবাস করে তারপর যখন সে মুরতাদ হয়ে যায়, তাকে অবশ্যই দুর্নামের ভাগি হতে হবে এবং সামাজিক মর্যাদা হারাতে হবে। এ কথা আমাদের কারোই অজানা নয়। আমাদের সমাজে এ ধরনের মুনাফেক অসংখ্য। যারা বাস্তবে ইসলামের অনুশাসনে বিশ্বাস করে না এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনে না। কিন্তু তারা সমাজে নিজেদের মুসলিম বলে প্রকাশ করে এবং মুসলিম হওয়ার সুবিধাও ভোগ করে, অপর দিকে বিজাতিদের সাথে তাল মিলিয়ে তাদের থেকেও সুবিধা নেয়। তারা ইসলামের শত্রুদের দালালি করে। মুসলিম সমাজে বসবাস করে মুসলিমদের কিভাবে ক্ষতি করবে এ চিন্তায় তারা বিভোর থাকে।

বড় নিফাকী ও ছোট নিফাকীর মধ্যে পার্থক্য:

১. বড় নিফাকী বান্দাকে ইসলামী মিল্লাতের গন্ডী থেকে বের করে দেয়। পক্ষান্তরে ছোট নিফাকী (আমলী নিফাকী) মিল্লাত থেকে বের করেনা।

২. বড় নিফাকীর মধ্যে আক্বীদার ক্ষেত্রে ভেতরে ও বাহিরে (বাতেন ও জাহের) দু‘রকম থাকে। আর ছোট নিফাকীর মধ্যে আক্বীদাহ নয়,বরং শুধু আমলের ক্ষেত্রে অন্তর-বাহির দু‘রকম থাকে।

৩. বড় নিফাকী কোন মু‘মিন থেকে প্রকাশ পায়না। কিন্তু ছোট নিফাকী কখনো মু‘মিন থেকে প্রকাশ পেতে পারে।

৪. বড় নিফাকীতে লিপ্ত ব্যক্তি সাধারণতঃ তওবা করেনা। আর তওবা করলেও তার গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। অথচ ছোট নিফাকীতে লিপ্ত ব্যক্তি অনেক সময়ই তওবা করে থাকে এবং আল্লাহ ও তার তওবা কবুল করেন।

কুরআন ও হাদিসে মুনাফিকদের চরিত্র:

১. মুনাফিকদের অন্তর রুগ্ন ও ব্যাধিগ্রস্ত:

২. মুনাফিকদের অন্তরে অধিক লোভ-লালসা:

৩. মুনাফিকরা অহংকারী ও দাম্ভিক:

৪. মুনাফিকদের চরিত্র হল, আল্লাহ তা‘আলার আয়াতসমূহের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা:

৫. মুমিনদের সাথে বিদ্রূপ:

৬. মানুষকে আল্লাহর রাহে খরচ করা হতে বিরত রাখা:

৭. মুনাফিকদের মূর্খতা ও মুমিনদের মূর্খ বলে আখ্যায়িত করা:

৮. কাফেরদের সাথে তাদের বন্ধুত্ব:

৯. তারা মুমিনদের পরিণতি দেখার অপেক্ষায় থাকে:

১০. মুনাফিকদের চরিত্র হল, আল্লাহকে ধোঁকা দেয়া ও ইবাদতে অলসতা করা:

১১. দ্বিমুখী নীতি ও সিদ্ধান্ত হীনতা:

১২. মুমিনদের ধোঁকা দেয়া:

১৩. গাইরুল্লাহর নিকট বিচার ফায়সালা নিয়ে যাওয়া:

১৪. মুমিনদের মাঝে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা:

১৫. মিথ্যা শপথ করা, কাপুরুষতা ও ভীরুতা:

১৬. তারা যা করেনি তার উপর তাদের প্রশংসা শুনতে পছন্দ করত:

১৭. মুনাফিকরা নেক আমলসমূহের দুর্নাম করত:

১৮. তারা নিম্নমান ও অপারগ লোকদের প্রতি সন্তুষ্টি:

১৯. মুনাফিকরা খারাপ কাজের আদেশ দেয় আর ভালো কাজ থেকে নিষেধ করে:

২০. জিহাদকে অপছন্দ করা ও জিহাদ হতে বিরত থাকা:

২১. অপমান ও অপদস্থের দায়িত্ব কাঁধে নেয়া:

২২.মুমিনদের থেকে পিছে হটা

২৩. জিহাদে না গিয়ে বিভিন্ন ওজুহাত দাঁড় করানো:
২৪. গান শ্রবণ করা:
২৫. অশ্লীল কথা বলা ও বেশি কথা বলা: 

২৬. মুমিনদের মুসিবতে খুশি হওয়া:

২৭. যখন আমানত রাখা হয় খিয়ানত করে যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে, আর যখন প্রতিশ্রুতি দেয়, তা ভঙ্গ করে আর যখন ঝগড়া করে অকাট্য ভাষায় গাল-মন্দ করে।

২৮. সময় মত সালাত আদায় না করা:

২৯. জামাতে সালাত আদায় করা হতে বিরত থাকা:



নিফাক থেকে বাঁচার উপায়।

. এক. প্রথম ওয়াক্তের মধ্যে সালাত আদায় করা এবং ইমামের সাথে তাকবীরে তাহরীমায় শরীক হওয়া।

. দুই. উত্তম চরিত্র ও দ্বীনের জ্ঞান:

. তিন. সদকা করা:

. চার. কিয়ামুল্লাইল করা।

. পাঁচ. আল্লাহর রাহে জিহাদ করা:

. ছয়. আল্লাহর যিকির বেশি করা:

. সাত. দোয়া করা:

. আট. আনছারীদের মহব্বত করা:


মুনাফিকদের বিষয়ে একজন ঈমানদারের অবস্থান কি হওয়া উচিত?

১. মুনাফিকদের আনুগত্য করা হতে বিরত থাকা:

২. মুনাফিকদের সাথে বিতর্ক করা থেকে বিরত থাকা, তাদের ধমক দেয়া ও ভালো হওয়ার জন্য উপদেশ দেয়া:

৩. তাদের সাথে বিতর্ক না করা এবং তাদের থেকে আত্মরক্ষা করা:

৪. তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা থেকে বিরত থাকা:

৫. তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা এবং তাদের বিষয়ে কঠোর হওয়া।

৬. মুনাফিকদের নিকৃষ্ট বলে জানা এবং কখনো তাদের কাউকে নেতা না বানানো:

৭. তারা মারা গেলে তাদের জানাজায় অংশ গ্রহণ করা হতে বিরত থাকা:

1 টি মন্তব্য: